অনলাইন মার্কেটিং কে পেশা হিসেবে বেছে নেয়ার পর থেকেই যে সমস্যাটা খুব বেশি বোধ করছিলাম তা হচ্ছে কথা কম বলা। ক্লায়েন্ট এর সাথে মিটিং, টিম মেম্বার দের সাথে ব্রেইনস্টোরমিং, আর বন্ধু এবং পরিবারের সাথে আড্ডা এ সময়টুকু ছাড়া আর তেমন কথা বলা হয়ে উঠে না। মুখের কাজ কমিয়ে ভাগ করে দেয়া হয়েছে আঙ্গুল এবং চোখ দুটিকে। যদিও মস্তিস্ক কথা বলে নিয়মিত, কিন্তু বেশীর ভাগ ক্ষেত্রেই তা ভিতরেই থেকে যায়। ২০ই মে, ২০১৪ ছিল বাংলাদেশের ইন্টারনেট মার্কেটার দের জন্য একটি বিশেষ দিন। প্রথমবারের মত আয়োজন করা হয়েছে ইন্টারনেট মার্কেটারদের আড্ডা ২০১৪। এই দিন আমরা প্রায় ৩০-৪০ জন অভিজ্ঞ এবং তুলনামুলক ভাবে নতুন ইন্টারনেট মার্কেটাররা মেতে উঠেছিলাম আড্ডায়। আড্ডা বলতে যা বুঝায় ঠিক তেমনটাই হল, সবাই মিলে মন খুলে কথা বললাম এই ইভেন্টে। এত মজার মধ্যেও আড্ডাটা ছিল গুরুত্তপুর্ণ দিকনির্দেশনাতে ভরপুর। সেখান থেকেই ৭ টি গুরুতবপুর্ন দিকনির্দেশনা তুলে ধরছি আমার এই ব্লগ পোষ্ট এ।
(প্রথম বারের মত আয়োজন, এবং জায়গা সংকটের জন্য এই আয়োজনে অনেককেই আমন্ত্রন জানানোর সুযোগ হয়ে উঠেনি। সেই জন্য আমরা সবাই দুঃখিত। লিডস টেকনোলজি লিমিটেড কে অসংখ্য ধন্যবাদ তাদের অফিস স্পেস ব্যাবহার করতে দেয়ার জন্য।)
১-আমাদের বাধাগুলো আমাদের কেই অতিক্রম করতে হবে
আপনি যখন যে অবস্থাতেই থাকেন না কেন প্রতিনিয়ত আপনি যাকে আপনার সবসময়ের সঙ্গী হিসেবে পাবেন সে হচ্ছে বাধা। প্রতিনিয়ত কোন না কোন বাধা আপনার কাছে আসবে আর ততক্ষন পর্যন্ত আপনাকে সঙ্গ দিবে যতক্ষন না আপনি নিজে থেকে কিছু করছেন সেই বাধা দূর করার জন্য। তাই আমাদের নিজদেরকেই তৈরী থাকতে হবে যেন আমরা আমাদের প্রফেশনাল চলার পথে যত বাধা পাই তা নিজেরাই সমাধান করতে পারি, অন্য কারো অপেক্ষাতে বসে না থেকে। উদাহরন সরুপঃ
আমাদের দেশে এখন পেপাল নেই, এটা ভেবে যারা বসে আছে তারা শুধু বসেই আছে, আর কিছু মানুষ ঠিকই তার সমস্যার সমাধানের জন্য একটা উপায় বের করেছে। কেউ হয়ত তার কোন আত্মীয় এর একাউন্ট ব্যাবহার করছে, কেউ হয়ত পায়োনিয়ার কার্ড দিয়ে ভেরিফাই করেছে, কেউ হয়ত অন্য কোন মাধ্যম ব্যাবহার করছে। আবার কেউ হয়ত প্রানপন চেষ্টা চালাচ্ছে সংস্লিষ্ট মহলের মাধ্যমে পেপাল নিয়ে আসার জন্য। আবার ঠিক একই সময় কেউ হয়ত অলস ভাবে বসে বসে অপেক্ষা করছে পেপাল কবে আসবে, পেপাল কবে আসবে, আর ভাবছে পেপাল থাকলে এখন আমার ব্যাবসাটা কতই না ভাল হত।
২-ইন্টারনেট মার্কেটার হতে হলে নিজেকে প্রমোট করার সাহস এবং যোগ্যতা থাকতে হবে
একজন ইন্টারনেট মার্কেটার এর মূল দায়িত্ত হচ্ছে একটা ব্যাবসা/পন্যকে প্রচার করা, তার বিক্রি বাড়িয়ে দেয়া, তার সুনাম তৈরী করা। এখন আপনি যদি নিজেকেই প্রমোট করতে না পারেন তাহলে আপনি ক্লায়েন্ট এর ব্যাবসাকে কিভাবে প্রমোট করবেন। আপনি ক্লায়েন্ট এর ব্যাবসার চাইতেও নিজেকে, নিজের লক্ষ্য কে, নিজের ক্ষেত্র কে বেশী ভাল করে জানেন, অর্থাৎ নিজেকে প্রমোট করা ক্লায়েন্ট এর ব্যাবসা প্রমোট করার চাইতে তুলনামুলক ভাবে সহজ। তাই আপনি যদি এখানে মনযোগ না দেন তাহলে যে দুটা কথা মাথায় আসবে সেটা হচ্ছে, হয় আপনি আপনার কাজ / কেরিয়ার নিয়ে সচেতন না, অথবা আপনি নিজেকে প্রমোট করতে ভয় পান। মার্কেটপ্লেস থেকে কাজ নেয়ার ক্ষেত্রে এটা তেমন একটা বড় সমস্যা না হলেও যখনি আপনি আপনার ব্যাবসা অথবা কেরিয়ারকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যেতে চাইবেন তখনই উপলব্ধি করতে পারবেন নিজেকে প্রমোট করাটা কতটা জরুরী। তাই এখন থেকেই সবার উচিত নিজেকে প্রমোট করার দক্ষতা বৃদ্ধিতে মনযোগী হওয়া। উধাহরণ স্বরুপ কাশেম ভাই এবং আসিফ ভাই এর কথা বলতে পারি। আপনি যদি এদের সোস্যাল মিডিয়াতে ফলো করেন তাহলে বুঝতে পারবেন কিভাবে নিজেকে প্রমোট করতে হয়।
৩-প্রতিটি ব্যার্থতা সফলতার রাস্তা সহজ করে দেয়
“ফেইলর ইস দ্যা পিলার অফ সাকসেস” এই প্রবাদটি ছোটবেলায় ট্রান্সলেশনে পড়েছিলাম। ইংরেজী ব্যাকরণে পড়েছিলাম এটি প্রেজেন্ট ইনডিফিনিট টেন্স এর উধাহরণ, কারন ইহা চিরন্তন সত্য 😛
আপনার প্রতিটি ব্যার্থতা আপনার কাছ থেকে অনেক কিছু কেড়ে নিলেও আপনাকে যা দিয়ে যাবে সেটা হচ্ছে কিছু অভিজ্ঞতা, দিকনির্দেশনা, এবং আবার নতুন করে শুরু করার অনুপ্রেরনা। আমাদের শুধু ব্যার্থতার প্রদত্ত মেসেজ গুলাকে রিড করতে জানতে হবে। তাই ব্যার্থতাতে ভেঙ্গে পড়ার কিছু নেই, এমন কি বার বার ব্যার্থ হলেও না, কারন একটা সফলতা আপনার সব ব্যার্থতাকে ছাড়িয়ে যাবার জন্য যথেষ্ট। আমি কিভাবে শুরু করেছিলাম সেইটা নিয়ে আমি ২০১৩ সালে একটি প্রেসেন্টেশন বানিয়েছিলাম, আপনারা চাইলে এখান থেকে তা দেখে নিতে পারেন।
৪- ব্যার্থ প্রজেক্টকে ফেলে না রেখে কিছুটা হলেও ফিডব্যাক বের করে নেয়া উচিত
প্রতিটা ব্যার্থতা যেমন নতুন ভাবে শুরু করার এবং সফল হবার রাস্তা দেখিয়ে দেয়, ঠিক একই ভাবে প্রতিটা ব্যার্থতা আপনাকে কিছু দিক থেকে একটু পিছিয়েও দেয়। যেমন আপনার ব্যার্থ প্রজেক্ট এর পিছনে ব্যয় করা অর্থ এবং সময়। তাই যখন কোন প্রজেক্ট ব্যার্থ হয়ে গেল, তখন আমরা একটু ভেবে দেখতে পারি, এই প্রজেক্ট এ যা অবশিষ্ট রয়েছে তা কিভাবে ব্যাবহার করা যায়। কিভাবে এই এসেটগুলোকে পুনরায় ব্যাবহার করা যায়, এবং এটা সফল ভাবে করতে পারলে শুধু যে আর্থিক ভাবেই কিছুটা সহায়ক হবে তাই নয়, এটা আপনাকে নতুন করে শুরু করার জন্য ভীষন ভাবে অনুপ্রানিত করবে।
৫- আইটি ব্যাবসার ধরন এবং পন্য সময়ের সাথে সাথে পরিবর্তন হতে পারে, তাই প্রস্তুত থাকা জরুরি
পৃথিবীর অন্যান্য সব ব্যাবসয়ার চাইতে আইটি ব্যাবসার ধরণ, পন্য, চাহিদা খুব দ্রুত পরিবর্তন হয়। তাই যখন কেউ আইটি সেক্টর এ ব্যাবসা অথবা কেরিয়ার শুরু করতে চান, তখন সেই পরিবর্তন এর সাথে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার মন-মানষিকতাও থাকতে হবে। ধরে নেই একজন থিম ডেভলপার এর কথা, বর্তমানে ওয়ার্ডপ্রেস খুব জনপ্রিয়। কিন্তু সারাজীবন ওয়ার্ডপ্রেস সিএমএস টাই যে জনপ্রিয় থাকবে তার কোন নিশ্চয়তা নেই। তাই যখন কেউ থিম ডেভেলোপমেন্ট এর ব্যাবসা শুরু করলো, তখন তাকে এটাও মাথায় রাখতে হবে, যদি কখনো অন্য কোন সিএমএস জনপ্রিয় হয়ে যায়, তখন যেন সেই সেক্টর এ কাজ করার জন্য নিজেদের ব্যাবসার ধরন / পন্য পরিবর্তন করা যায়।
৬-ক্লায়েন্ট ডিলিং এবং ক্লায়েন্ট কনভেন্সিং এর দক্ষতা বাড়াতে হবে
আপনার ব্যাবসাকে সফল করে তুলতে হলে যে তিনটি যায়গাতে আপনাকে দক্ষ হতেই হবে
- ক্লায়েন্ট কনভিন্স করা
- ক্লায়েন্ট এর কাজ ঠিক সময়ে, ঠিক ভাবে সম্পন্ন করা
- সুন্দর, গোছানো রিপোর্টিং এবং ক্লায়েন্ট এর সাথে নিয়মিত যোগাযোগ রক্ষা করা।
১ এবং ২ নম্বর উভয় ক্ষেত্রে আপনাকে সফল হতে হলে আপনার যেই স্কিলটি সবার প্রথমে দরকার তা হচ্ছে কমিউনিকেশন স্কিল বৃদ্ধি করা। তাই ব্যাবসায়িক ভাবে সফল হতে হলে একজন উদ্যোক্তার অবশ্যই তার কমিউনিকেশন স্কিল, ক্লায়েন্ট ডিলিং করার উপর দক্ষতা বাড়াতে হবে।
৭-লিখালিখির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে
চর্চা ছাড়া কিছু সুন্দর এবং সফল ভাবে করতে পারা অনেকটা অসম্ভব। ভাল খেলোয়াড় হতে চান? আপনাকে নিয়মিত মাঠে চর্চা করতে হবে। আলোকচিত্র শিল্পী হতে চান? ক্যামেরার পিছনে সময় দিতে হবে। ঠিক একই ভাবে ভাল মার্কেটার হতে হলে আপনাকে লিখালিখির অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। ধরুন আপনি একটি অনুষ্ঠানে বক্তব্য দিলেন। আপনার পক্ষে এনালাইজ করা কষ্টকর হবে আপনার বক্তব্য মানুষ কিভাবে নিয়েছেন। যদি আপনার বক্তব্য খুব খারাপ এবং বিরক্তিকর ও হয়, কেউ আপনাকে সেটা বলবে না, এবং আপনার পক্ষেও সঠিক সমস্যা গুলো খুজে বের করা তুলনামুলক ভাবে কষ্টকর হবে। কিন্তু লিখার ক্ষেত্রে ঘটনা কিছুটা অন্যরকম হয়। আপনি কোন একটা কন্টেন্ট লিখার পর সেটা যখন কিছুদিন পর পড়বেন, আপনি নিজেই কিছু ভুল/দুর্বলতা খুজে পাবেন। যা আপনার দক্ষতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে। তাছাড়া লিখার মধ্যে আপনি আপনার পাঠক দের কাছ থেকে তুলনামুলক ভাবে বেশি ফিডব্যাক জানতে পারবেন। আর আপনার একই লিখা যেহেতু লাইফটাইম ওয়েবে রাখা যাবে, তাই আপনি এটা থেকে বেশি লিড, বেশী পাঠক অনেক লম্বা সময় ধরে পাবেন। তাই আমরা যারা এখনো লিখা লিখি শুরু করিনি, তারা চাইলেই শুরু করে দিতে পারি। ১ বছর লিখার পর আপনি যদি আপনার ১ বছর আগের লিখা পড়েন তাহলে উন্নতিটা আপনি নিজের চোখেই দেখতে পারবেন।
আমরা আরো ছোট খাট অনেক বিষয় নিয়ে আলোচনা করেছিলাম, আমার যতটুকু মনে পড়েছে ততটুকুই লিখলাম। আমি যেগুলো মিস করেছি কেউ চাইলে কমেন্ট সেকশন এ লিখে তা পাঠকদের জানিয়ে দিতে পারেন।