প্রতিবছর ১০ লক্ষাধিক শিক্ষার্থী দেশের প্রায় ১৫০ টির অধিক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করে। এর মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষার্থী ভবিষ্যতের স্বপ্নের চাকরির জন্য নিজেদের প্রস্তুত করেন আবার অনেকেই নিজেকে উদ্যোক্তা হিসেবে নিজের স্বপ্ন পূরণের জন্য ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠেন।
ছাত্রাবস্থায় প্রত্যেকটা শিক্ষার্থীর একটা স্বপ্ন থাকে দেশের যে কোন মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পনিতে সর্বোচ্চ পদের নিজেকে অধিষ্ঠিত করা যার ফলে সে সমাজে খুব সিকিউরড এবং ভালো অবস্থানে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারেন।
কিন্তু একটা সময়ে বাংলাদেশ বরাবরই ম্যানেজমেন্ট এবং নেগোশিয়েশন স্কীল নিয়ে স্ট্রাগল করেছে। তাই বাংলাদেশের বেশির ভাগ বড় প্রতিষ্ঠানেই বিদেশি টপ ম্যানেজমেন্ট দেখা যেত। মাল্টিনেশনাল কোম্পানিয়ের ক্ষেত্রে এর বিকল্প ভাবাই যেত না। কিন্তু সুখবর হচ্ছে দিন বদলেছে। আজকের পোষ্ট মূলত ৭ জন সাকসেসফুল কর্পোরেট প্রফেশনালদের নিয়ে যারা লিড করছে বাংলাদেশের ৭ টি বড় প্রতিষ্ঠান।
৭ বাংলাদেশি নির্বাহী প্রধান যারা দেশকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়
শেহজাদ মুনিম
শেহজাদ মুনিম ২০১৩ সালের ১ লা অক্টোবর ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো বাংলাদেশ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হোন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – এর ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে ১৯৯৭ সালে তিনি ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো তে টেরিটরি অফিসার হিসেবে তার ক্যারিয়ার শুরু করেন। ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো- বাংলাদেশ এর পাশাপাশি ২০০৩ সালে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো নিউজিল্যান্ড-এর গ্রুপ ব্র্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণের পূর্বে শেহজাদ মুনিম ব্রিটিশ আমেরিকা বাংলাদেশ-এর বিভিন্ন মার্কেটিং ভূমিকায় কাজ করেন।
অস্ট্রেলিয়ার সিডনিতে পণ্য এবং প্যাকেজিং উদ্ভাবন ম্যানেজার হিসেবে নিযুক্ত হয়েছিলেন ২০০৬ সালে। এরপর ২০১০ সালে দক্ষিণ এশিয়ার হেড অব মার্কেটিং হিসেবে দ্বায়িত্ব গ্রহণ করেন। খুব অল্প সময়ের ব্যবধানে জনাব মুনির ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর “বোর্ড অব ডিরেকটরস” হিসেবে নিযুক্ত হোন।
ইয়াসির আজমান
২০২০ সালের পূর্বে গ্রামীনফোনের ইতিহাসে কোন বাংলাদেশি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার গৌরব অর্জন করে নাই যা ইয়াসির আজমান এর মাধ্যমে এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এসেছে। ইয়াসির আজমান ২০১৫ সালের জুন মাসে চিফ মার্কেটিং অফিসার হিসেবে গ্রামীনফোন যোগদান করেন এরপর ২০১৭ সালে ডেপুটি সি ই ও হিসেবে নিযুক্ত হোন। চিফ মার্কেটিং অফিসার হিসেবে যোগদানের পূর্বে তিনি টেলিনর গ্রুপের হেড অফ ডিস্ট্রিবিউশন এবং ই-বিজনেস এ দ্বায়িত্ব পালন করেন। গ্রামীনফোন-এর সেলস এবং ডিস্ট্রিবিউশন স্থাপন এবং এর কাঠামো রুপান্তরে ইয়াসির আজমান গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।
ইয়াসির আজমান ১৯৯৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – এর ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন থেকে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী অর্জন করেন। এরপর ইউনিভার্সিটি অব লন্ডন থেকে স্ট্র্যাটেজিক মার্কেটিং প্রোগ্রাম উপর বিশেষ ডিগ্রী অর্জন করেন।
জাভেদ আখতার
২০২১ সালের ১লা জুলাই জাভেদ আখতার ইউনিলিভার এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে নিযুক্ত হোন। তিনি ইউনিলিভার-এর দক্ষিণ এশিয়া লিডারশীপ টিমে যোগদান করেন। তাছাড়া তিনি দক্ষিণ এশিয়ার ডিজিটাল কাউন্সিল এর ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হোন যেখানে তিনি ডিজিটাল ট্রান্সফোরমেশন এবং গ্রোথ এর জন্য নেতৃত্ব প্রদানের গৌরব অর্জন করেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – এর ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন থেকে স্নাতক সম্পন্নের পর মার্কেটিং প্রফেশনাল হিসেবে জাভেদ আখতার ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে তার ক্যারিয়ার জীবন শুরু করেন। এরপর ২০০০ সালে ওরাল কেয়ার ক্যাটাগরি বিজনেস এ সিনিয়র ব্র্যান্ড ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন।
জাভেদ আখতার তার দীর্ঘ ২৪ বছরের পেশাগত জীবনে দক্ষিণ এশিয়া, দক্ষিন-পূর্ব এশিয়ার কাস্টমার সেন্ট্রিসিটি, ডিজাইন থিংকিং এবং ইনোভেশন ম্যানেজমেন্ট এর উপর অভিজ্ঞতা এবং পারদর্শিকতা অর্জন করেন।
গোলাম মুর্শেদ
মার্কেটিং ওয়াচ বাংলাদেশ- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠানের সাম্প্রতিক এক গবেষণায় দেখা যায়, বাংলাদেশের রেফ্রিজারেটরে মোট মার্কেট শেয়ারের প্রায় ৮০ শতাংশই লোকাল ম্যানুফ্যাকচারদের দখলে, যেখানে এক সময় বাংলাদেশকে রেফ্রিজারেটর এবং আমদানির উপর নির্ভর ছিলো। এই ৮০ শতাংশ মার্কেট শেয়ারের মধ্যে ৬৬ শতাংশ ওয়াল্টন-এর দখলে।
ওয়াল্টন গ্রুপের এই বৈপ্লবিক বিবর্তনের পিছনে যার অবদান সবচেয়ে বেশি তিনি হচ্ছেন গোলাম মুর্শেদ। বর্তমানে তিনি ওয়াল্টন হাই-টেক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক এবং প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা।
২০১০ সালে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং স্নাতক সম্পন্ন করে ওয়ালটনে যোগদান করেন প্রডাকশন ইনচার্জ হিসেবে। যখন ফ্রিজের প্রডাকশন লাইনে কাজ করতেন তখন তৎকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক গোলাম মুর্শেদকে বিজনেস অপারেশনের দ্বায়িত্ব প্রদান করেন। এই দ্বায়িত্ব গ্রহনের তিন বছরের মধ্যে তিনি ওয়াল্টন রেফ্রিজারেটর ডিপার্ট্মেন্টে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হোন।
নাসির এজাজ বিজয়
২০১৭ সালের ৭ই নভেম্বর নাসির এজাজ বিজয় স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হোন। নাসির এজাজ এর ক্যারিয়ার শুরু হয় ১৯৯২ সালে। ঢাকা সিটি কলেজ থেকে কমার্স এ স্নাতক ডিগ্রী সম্পন্ন করে তিনি স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংক-এ চাকরিজীবন শুরু করেন একজন শিক্ষানবিশ হিসেবে। তার ২৯ বছর বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার জীবনে তিনি ব্যাংকিং-এর বিভিন্ন সেকটরে অভিজ্ঞতা এবং পারদর্শিকতা অর্জন করেন। সেই সাথে দক্ষিণ এশিয়া, মিডল ইস্ট এবং আফ্রিকায় স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংক এ নেতৃত্ব দেন।
স্ট্যান্ডার্ড চ্যার্টার্ড ব্যাংকের পাশাপাশি ফরেন ইনভেস্টরস চেম্বার অফ কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিতে ২০২২-২০২৩ সালের প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হোন। তিনি ডিউক অব এডিনবার্গ এওয়ার্ড ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের বোর্ড অব মেম্বার হিসেবে অন্যতম। এছাড়া তিনি মেট্রোপলিটন চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রিজ, ঢাকা এবং ব্রিটিশ বিজনেস গ্রুপের সাথে জড়িত।
রুপালী চৌধুরী
বাংলাদেশের ইতিহাসে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে রূপালী চৌধুরী এক অনন্য বিরল নক্ষত্রের নাম। তিনি ২০০৮ সালের ১লা জানুয়ারি থেকে বার্জার এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করে আসছেন। বাংলাদেশে পেইন্টিং ইন্ডাস্ট্রিতে এক অনন্য উচ্চতায় পৌছানো এবং শীর্ষস্থানীয় পেইন্ট ম্যানুফেকচার কোম্পানির জন্য তার অবদান অনস্বীকার্য।
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে এপ্লাইড সায়েন্স থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় – এর ইনস্টিটিউট অব বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশন থেকে মাস্টার্স ইন বিজনেস এডমিনিস্ট্রেশনে কৃতিত্বের সাথে উত্তীর্ণ হোন। তার পেশাগত জীবনের সূচনা ঘটে ১৯৮৪ সালে সিবা গাইগি নামক একটি মাল্টিন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল এবং কেমিক্যাল কোম্পানি এর মাধ্যমে।
এরপর ১৯৯০ সালে বার্জার পেইন্টস বাংলাদেশ- প্ল্যানিং ম্যানেজার হিসেবে যোগদান করেন। এরপর একাধারে তিনি মার্কেটিং সেলস, ডিস্ট্রিবিউশন এবং প্ল্যানিং এর বিভিন্ন সেক্টরে অভিজ্ঞতা এবং পারদর্শিকতা অর্জন করেন। সেই সাথে তিনি বার্জার এর একটি সাব সিডারি প্রতিষ্ঠান জেনসন এবং নিকলসন এর চেয়ার পারসন এবং ম্যানেজিং ডিরেকট হিসেবে দ্বায়িত্ব পালন করেন।
সেই সাথে রূপালী চৌধুরি বাটা বাংলাদেশ, লিন্ডে বাংলাদেশ এর একজন ইণ্ডিপেন্ডেন্ট ডিরেকটর। সেই সাথে তিনি ইউনিসেফ বাংলাদেশ এর এডভাইসরি বোর্ড এর একজন সদস্য এবং বাংলাদেশ পেইন্ট ম্যানুফেচারার এসোসিয়েশন-এর প্রেসিডেন্ট। তিনি ২০১৯ সালে আউটস্ট্যান্ডিং ওমেন ইন বিজনেস-এর এওয়ার্ড অর্জন করেন।
মোহাম্মদ মাহবুব উর রহমান
একজন বাংলাদেশি হিসেবে মাল্টিন্যাশনাল ব্যাংকিং এর লিডিং পজিশনে থাকা হংকং সাংগাই ব্যাকিং করপোরেশনে প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিজের নাম লেখানো মোটেও সহজ ছিলো না, যা মোহাম্মদ মাহবুব উর রহমান করতে সক্ষম হয়েছেন ২০২০ সালের এপ্রিল মাসে। ২০০২ সালে মাহাবুব উর রহমান এইচ এস বি সি বাংলাদেশ এর লোকাল প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্ত হোন। প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগপ্রাপ্তির পুর্বে তিনি ডেপুটি প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে নিযুক্ত ছিলেন।
হংকং ইউনিভারসিটি অব সায়েন্স এন্ড টেকনোলজি থেকে স্নাতক ডিগ্রী অর্জনের পর মাহবুব ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ফিন্যান্স এ মাস্টার্স সম্পন্ন করেন।
দেশি বিদেশি মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিগুলোতে কর্মরত এই প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা আমাদের জন্য অনুকরনীয়। যেখানে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্ম কোন ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে ব্যবস্থাপনা পর্ষদে যোগদানের দক্ষতা, যোগ্যতা এবং সামর্থ্য রাখে। আশা করি তাদের জীবন কাহিনী অনেকের জন্য শিক্ষা এবং অনুপ্রেরণা যোগাবে।
তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেট